একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতার ঢেউ এসেছিল যে উজান থেকে, সেটি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। সেই উজান থেকে ভাষা আন্দোলনের শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের রক্তের নদী উনসত্তরে বাঁক নিয়ে একাত্তরে আসে ভাটিতে, আর সব রক্তনদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতা।
ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার দেড় যুগ পর ১৯৭১ সালে আসে আমাদের স্বাধীনতা, আর প্রায় অর্ধশতক পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় বায়ান্নর সেই আত্মত্যাগ। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। সেদিন থেকে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
তবে আমাদের কাছে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসই পরম শ্রদ্ধা–সম্মানের মাস। বছর ঘুরে আবার সামনে এসেছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথে জীবন বাজি রেখে যারা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গেছিলেন, ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন, তাদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা–সম্মান–হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা প্রকাশের মাস ফেব্রুয়ারি।
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। সেই ক্ষোভ থেকে জন্ম নেওয়া আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অমান্যের কারণ দেখিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে।
জীবন বলিদানের সেই পথ পরিক্রমায় বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। সেই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মানচিত্র ও পতাকা।
বিশ্বে বিরল এই আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। আর এরমধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের নানান দেশে পালন করা হয়। কারণ পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালিই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল।
প্রতিবারের মতো ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে নানা কর্মসূচি। তবে করোনার আগে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি ১ম দিন থেকে বাংলা একাডেমি কেন্দ্রীক মাসব্যাপী বইমেলা শুরু হলেও এবার তা হচ্ছে না। মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির পর্যন্ত স্থগিত আছে।